প্রতিদিনের মতোই কলেজ যাব বলে বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। একটু দেরি হয়ে গেছে, তাই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এসে পৌঁছালাম পাড়ার অটোস্ট্যান্ডে । কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার অন্য দিনের মতো অটোস্ট্যান্ডে মানুষের তেমন ভিড় নেই। সম্ভবত শোয়া এগারোটার দিকে ভিড় একটু বেশি থাকে, কিন্তু আজ হাতেগোনা কয়েকজনই আছে। যাই হোক ,দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রায় মিনিট দশেক পেরিয়ে গেছে। কিন্তু একটা অটোরও দেখা নেই। ফলে কয়েকজন মানুষ ও যারা ছিলেন তারা দেখলাম নিজেদের গন্তব্যের দিকে পাড়ি দিচ্ছেন । আমিও ভাবলাম আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, তাই সবেমাত্র কলেজের দিকে হাঁটা লাগাতে যাব ঠিক তখনই একটা রিক্সা এসে দাঁড়ালো আমার সামনে । রিক্সাটির দিকে নজর পড়তেই আমি একপ্রকার মুগ্ধ হয়ে গেলাম, কারণ রিক্সাটা আমার দেখা আর পাঁচটা রিক্সার মত নয়। একটু অন্য ধাঁচে তৈরি। একটা রাজকীয় ব্যাপার আছে তার মধ্যে। সাজানো, গোছানো যেন এক পরীর যান। আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিলাম রিক্সাটার দিকে ঠিক তখনই রিক্সা চালক আমাকে বলে উঠলেন `কি দিদিমণি যাবেন আমার রিক্সায়?’ চালকের কথায় আমি বাস্তবে ফিরলে তিনি আবার সেই একই বাক্য আওড়ালেন। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে,তার মধ্যে একটাও অটো নেই আর এই গরমে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব ,তাই আমি রাজি হয়ে গেলাম রিক্সায় যাওয়ার জন্য। এতগুলো কারণ ছিল ঠিক কথা কিন্তু আমার রিক্সায় চড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণটি ছিল সেটি ছিল স্বয়ং সেই রিক্সা । এমন রিক্সা আমি এত বছরে কোনদিনও দেখিনি। তাই একপ্রকার বিস্ময় কাজ করছিল। আর এই বিস্ময় নিয়েই আমি রিকশায় চড়ে বসলাম, গন্তব্য কলেজ । আমি বসতেই চালক রিক্সা চালাতে শুরু করলেন।
বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর আমি লক্ষ্য করলাম রিক্সাটি আমার কলেজের দিকে না গিয়ে অন্য মোড় ধরেছে। চালকের এমন কাণ্ডে আমি অবাক হয়ে ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম ,`একি দাদা এটা তো আমার কলেজের রাস্তা নয়, কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’ আমার কথায় রিক্সাচালক মৃদু হেসে শুধু একটাই শব্দ বললেন “অতীতে”। ওনার কথার কোন খেই খুঁজে না পেয়ে আমি চুপচাপ বসে রইলাম। একটা আলাদাই অনুভূতি কাজ করছে যখন থেকে আমি রিক্সাটায় বসেছি। শুধু একটা কথাই মনে হল ,কি হয় দেখা যাক। আসলে সাংবাদিকতার ছাত্রী তো তাই হয়তো অ্যাডভেঞ্চার টা একটু বেশিই প্রিয়।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর, আমার আশপাশটা যেন কেমন বদলে গেল । চারিদিক জঙ্গলে ঘেরা বড় বড় গাছ। এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য আমি এর আগে কখনো দেখেছি বলে আমার মনে নেই। হঠাৎ রিক্সা থামিয়ে রিক্সাচালক আমাকে দূরে কিছু একটা দেখাতে চাইলেন। ওনার আঙ্গুল অনুসরণ করে সেই দিকে তাকাতেই নজরে এলো এক বড় জন্তু। ডাইনোসর হবে বোধ হয়! কিন্তু আমি তাদের দেখবো কি করে ?তারা যে এখন বিলুপ্ত! তাহলে কি ?কিছু ভেবে ওঠার আগেই রিক্সাচালক আবারও রিক্সা ছোটাতে শুরু করলেন।যেতে যেতে দেখলাম কিছু আদিম মানুষ মেতেছে তাদের আদিম পশু শিকার এর খেলায়।
কিছু সময় পর আমি দেখলাম জঙ্গলের পরিবেশ এখন আর নেই। আমার চারপাশটা ঢেকে গেছে বড় বড় মহলে। যেখানে হয়তো বাবর-আকবরের বাস।
এর বেশ কিছুক্ষণ চলার পর চালক রিক্সা থামালো। দেখতে পেলাম অগাস্টাস হিকির তৈরি করা ভারতের প্রথম ছাপাখানা। যেখানে শুরু হয়েছিল প্রথম ছাপার কাজ।
এরপর রিকশা এসে থামলো সম্ভবত ১৮৯৮ সালে। কারন চারিদিকে জয় জয়কার শোনা যাচ্ছে `উদ্বোধন’ পত্রিকার। স্বামী বিবেকানন্দের প্রকাশিত বাংলা ভাষার অন্যতম প্রাচীন পত্রিকার জয়জয়কার। প্রায় সবার হাতেই সেই পত্রিকা। এমন দৃশ্য দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার । হয়তো স্বামী বিবেকানন্দের প্রকাশিত বলেই পত্রিকার এত উন্নত শির।
রিকশা চলতে শুরু করল আবার। এবার পরপর চোখে পড়ল গান্ধীজি, সুভাষচন্দ্র এবং তাঁদের অনুগামীরা,সাথে চোখে পড়ল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো সব মহান ব্যক্তিরা ,যাঁরা হাঁটছে ভারত মাতা কে স্বাধীন করার পথে।
এত কিছু সব অবাস্তবিক ঘটনায় আমি যখন মন্ত্রমুগ্ধ, তখনই রিক্সাটা এসে থামলো একটি রাস্তায়। আমি চারপাশটা দেখে আর এক দফা চমকে উঠলাম। একি! এ তো সেই আমার পাড়ার অটো স্ট্যান্ডটা, যেখান থেকে সকালে আমি এই রিক্সায় উঠে ছিলাম। এখন সন্ধ্যে নেমেছে, এই যা ফারাক।
নেমে পড়লাম রিক্সা দিয়ে। দেখলাম চোখের সামনে দিয়ে দূরে মিলিয়ে গেল রিক্সাটা। এখনো আমি দাঁড়িয়ে আছি সেইখানে ,আর ভাবছি ,এটা কি কল্পনা নাকি বাস্তব? তাহলে কি সত্যিই রিক্সাটি সাধারন ছিল না? একেই কি বলে টাইম ট্রাভেল? ইউরেকা! তার মানে রিকশাটি টাইম ট্রাভেল রিকশা ছিল!
ঘটনাটি ঘটার পরের দিন যখন আমি আমার পরিবার, বন্ধু বান্ধব কে ঘটনাটি বললাম কেউই আমার কথা বিশ্বাস করলো না। উপরন্ত হাসি ঠাট্টা করতে লাগলো, আর সবাই বলতে লাগলো `স্বপ্ন দেখেছিস তুই, কল্পনা তোর। তুই তো আর ডোরেমন নস।’
বিষয়টা নিয়ে সবাই মজা করলেও আমি কি করে সেটাকে কাল্পনিক বলব? চোখের সামনে যা দেখেছি তা তো আর মিথ্যা হতে পারে না, আর সবচেয়ে বড় প্রমাণ আছে ইতিহাস। সবাই হাসি ঠাট্টা করলেও ইতিহাস তো ইতিহাসই আর টাইম ট্রাভেল, হ্যাঁ এটাও সত্যি। হয়তো সবাই একদিন এমন এক রিক্সার সম্মুখীন হবে, যে রিক্সা তাদেরকেও ঘুরিয়ে দেখাবে পুরো অতীতটাকে, ঠিক আমারই মতো করে।