শিলাইদহের সেই দোতলা বাড়ি,যার প্রতিটি কোণে মিশে রয়েছে স্মৃতি,যেখানে রচিত হয়েছিল নোবেলজয়ী কাব্য। আজ সেই বাড়িটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। ভেঙে পড়েছে ছাদ, ঘর বারান্দার অবস্থা তথৈবচ। ভেঙে গিয়েছে দরজা-জানলা, কিছু কিছু দরজা জানলা লোকে খুলে নিয়ে গেছে বলেও জানা যায়। খসে পড়ছে বাড়ির ইট , দেয়ালের পলেস্তারা। দেয়ালের গায়ে জন্মেছে বট পাকুড়, বাড়ির চারপাশ ছেড়েছে আগাছায়। এই বাড়িটির গায়েই এখন স্থানীয় মানুষজন শুকোতে দিচ্ছে ঘুঁটে,বাড়ির সামনে চরে বেড়াচ্ছে গরু ছাগল।
বাড়িটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহের রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটি এবং সংলগ্ন দাতব্য চিকিৎসালয় টি আজ অযত্নে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এই অঞ্চলের জমিদারি কেনেন।আজকের ধ্বংসাবশেষে রূপান্তরিত এই কাছারি বাড়িতে বসেই আদায় করা হতো জমিদারির খাজনা। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত দেবেন্দ্রনাথ এর নির্দেশে বাধ্য হয়ে এই অঞ্চলে জমিদারি পরিচালনা করেন কবি গুরু।
পূর্ববঙ্গের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মূলত চার যোগাযোগ ভূমি – শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসর এবং দক্ষিণডিহি। এর মধ্যে এই শিলাইদহ কবির সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে রয়েছে। রবীন্দ্র সাহিত্যেও এর অবদান ব্যাপক ১৯১৩ সালের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত গীতাঞ্জলির অধিকাংশ কবিতাই রচনা হয়েছিল এই শিলাইদহে। এখানেই কবি রচনা করেন কল্পনা,ক্ষণিকা,চৈতালি, সোনার তরী, চিত্রা, জীবনস্মৃতি, পঞ্চভূতের ডায়েরী, চিরকুমার সভা, ঘরে বাইরে, বলাকা ইত্যাদি। চোখের বালি র প্রাথমিক রচনা ও শুরু হয়েছিল এই খানে। অনেক গানও তিনি রচনা করেন এই শিলাইদহে।
পূর্ববঙ্গ শুধু কবির কাব্য সাহিত্যেই নয়, তার কাজেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। পল্লী পুনর্গঠন, সমবায়, যন্ত্র দিয়ে কৃষিকর্ম এমন অনেক নতুন চিন্তা ভাবনাও কবির মাথায় আসে, পূর্ববঙ্গবাসের মধ্যে থেকে।তাঁত শিল্পের উন্নতির উদ্দেশ্যে কুষ্টিয়ায় স্থাপন করেন বয়নবিদ্যালয়,কৃষকদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন পতিসরে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৮৯৮ সালে কবি স্ত্রীপুত্রকন্যা সহ বাস করতে থাকেন শিলাইদহে। ছেলে মেয়ের বিকল্প শিক্ষার কথা চিন্তা করতে গিয়ে শিক্ষার নতুন আদর্শের ভাবনা ভাবেন কবি, ফলস্বরূপ স্থাপিত হয় শান্তিনিকেতন।
যে জায়গাটির সঙ্গে কবিগুরুর এমন অন্তর যোগাযোগ, যেখানকার আকাশ বাতাসে জড়িয়ে আবেগ ও সৃষ্টিশীলতা র স্পন্দন, সেখানে তার স্মৃতি বিজড়িত বাড়ির আজ এই অবস্থা দেখে আশ্চর্য সবাই। স্থানীয় মহল মনে করেন, ঠিকমতো সংরক্ষণ ও সংস্কার হলে এই বাড়িটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হতে পারে। প্রত্নতত্ত্ব দফতর `সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’ হিসেবে বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছে বলে তাদের অভিযোগ। কিন্তু তাঁরা শুধু নোটিশ টাঙিয়েছে মাত্র, যার কোন গ্রাহ্যতা নেই। এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব দফতরের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক জানিয়েছেন, বাড়িটি এবং চিকিৎসালয় টি সংরক্ষণে তাঁরা কাজ করছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বরাদ্দ দিয়ে বাড়িটির মূল ভবনের কয়েকটি ঘর এবং ভেঙে পড়া ছাদের সংস্কার এবং অন্যান্য কাজও তাঁরা করবেন। ধীরে ধীরে বাড়িটিকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনা যথেষ্ট চেষ্টা করছেন তাঁরা।