রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ” শিল্প হচ্ছে তাই যা নিছক প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি তাগিদ থেকে মানুষকে চালনা করে শিল্প সৃষ্টিতে নিযুক্ত করে ” শিল্প বিষয়টি মানব সভ্যতার সৃষ্টির সাথে সাথে রূপ লাভ করেছে। সেই আদিমকাল থেকে মানুষের প্রকৃত বিকাশ না ঘটলো সৃষ্টি করেছে বহু শিল্প। শিল্প বিষয়টি বহু সময়ে শিল্পীদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করলেও প্রত্যেকে একটি বিষয়ের সহমত হয়েছেন – শিল্পের মধ্যে ভাব প্রকাশের যে একটি অবিরত তাগিদ আছে তারই বাহ্যিক রূপায়ণ।
বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ভ্যান গগ ১৮৮৯ সালে তার জীবনের শেষ ছবি দ্য ওয়েটফিল্ড উইথ ক্রোশ ( THE WHEAT FIELD WITH CROWS) এ মাধ্যেমে সাধারণ মানুষের মনে রেখে গেছেন অজস্র প্রশ্ন। অনেকে মনে করেন এই ছবিটি তাঁর জীবনের শেষ দিন গুলির প্রতীক এবং কাক গুলি মৃত্যু ও পুনর্জন্মের প্রতীক। এই নিয়ে বেশ কিছু জল্পনা থাকলেও আসল ভাবনা টা সম্পূর্ণই অজানা। হয়তো এখানেই একজন শিল্পীর সার্থকতা যেখানে তার শিল্প ভাবিয়ে তুলবে সাধারণ মানুষ কে। শিল্প ও সাধারণ মানুষের এক সম্পর্কের কথা বলতে গেলেই বিশ্ব খ্যাত সেতারবদক পণ্ডিত রবি শঙ্করের কথা না বললেই নয় । যিনি ৯২ বছর বয়সে মৃত্যু কালীন অবস্থাতেও শুধুমাত্র শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তাঁর সর্বশেষ সেতার বাদনটি নিবেদন করেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়াতে। তার ৪ সপ্তাহ পর ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর মঙ্গলবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরলোকগমন করেন এই মহান কিংবদন্তি শিল্পী। কিন্তু তাঁর সেই সর্বশেষ সেতারবাদনটির জন্য তিনি রয়েগেছেন সকল মানুষের মনে।
সাহিত্য শিল্পের একটি মুখ্য অংশ। সাহিত্য সামাজিক, দার্শনিক ও মনস্তাত্তিক ভাবে আগ্রহজনক কোনো বিশেষ বিষয়ের উপর লিখিত রচনাবলী। একটি প্রেমের কবিতা যেমন একজন মানুষকে ভালোবাসা শেখাতে পারে তেমনি একটি প্রতিবাদী মূলক লেখা পাল্টে দিতে পারে একটি সমাজের চিত্র। একজন লেখকই তার লেখার মাদ্যমেই বলে দিতে পারেন একটি সমাজের চিত্র। দেশের জন্য , সমাজের জন্য সাধারণ মানুষের জন্য – বাস্তব অবাস্তব বিভিন্ন উদাহরণের সাহায্যে নিজেদের ভাবনার বীজ ছড়িয়ে দিতে পারেন সাধারণ পাঠকদের মধ্যে। সাহিত্যের সঙ্গে নাটকের এক অদ্ভুত মিল বন্ধন রয়েছে। বিভিন্ন লেখা গল্প উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে সেগুলো মঞ্চস্থ করা হয়। তেমনি নাট্য জগতের এক কিংবদন্তি শিল্পী এই নাটক বিষয়টিকে এনেছিলেন সমাজের কাছে সাধারণ মানুষের কাছে । তিনি লক্ষ্য করেন, মঞ্চ নাটকে অভিনেতারা থাকে আলোয় আর দর্শকরা থাকে অন্ধকারে। নিজের জীবনের শীর্ষে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি তিনি উপলব্ধি করেন যে, থিয়েটারকে বৃহত্তর মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হলে মঞ্চ নাটকের এই সীমাবদ্ধতাগুলো ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। অভিনেতারা থাকে মঞ্চে উঁচুতে, আর দর্শকেরা থাকে নীচুতে দর্শকাসনে।অভিনেতাদের সঙ্গে দর্শকদের মত বিনিময়ের সুযোগ প্রায় থাকে না। তিনি দেখলেন ভারতে দুই ধরনের থিয়েটারের প্রচলন রয়েছে— এক , ভারতের গ্রামীণ সমাজে পালাগান, যাত্রাপালা, প্রভৃতি লোকনাট্যের প্রচলন রয়েছে । এটিকে তিনি ফার্স্ট থিয়েটার বলেন এবং দুই , ভারতের শহুরে সংস্কৃতিতে বিদেশী সংস্কৃতিকে অনুকরণ করে মঞ্চ নাটকের প্রচলন হয়েছে। এটা বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে।এটাকে তিনি সেকেন্ড থিয়েটার বললেন। এরপর ই তিনি একটি বিকল্প থিয়েটারের জন্ম দিলেন যা থার্ড থিয়েটার মনে পরিচিত । থার্ড থিয়েটার হবে খোলা জায়গায়, মঞ্চ থেকে বেরিয়ে মুক্ত মঞ্চে। মুক্ত মঞ্চ অর্থাৎ খোলা জায়গায় বিপুল সংখ্যক দর্শকের মাঝে। এই নাট্য পথের মাধ্যেমে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে। তিনি থেকে যেতে চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি চাননি এই থিয়েটার জগতটা শুধু থিয়েটার নয় এই শিল্প জগতকে কয়েকজন মানুষের মধ্যে আটকে রাখতে । শিল্পের প্রতি সবার সমান অধিকার আছে বুঝেই তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন চার দেওয়ালের বাইরে ও পাল্টে ছিলেন সেই সময়ের চিত্র।
শিল্পের একেকটি মাধ্যমের সঙ্গে একেকটি মাধ্যম এক অভূতপূর্ব ভাবে জড়িত, গান কে ছাড়া যেমন নাচ অসম্পূর্ণ, তেমনি নাট্য জগতে গান, নাচ, সাহিত্য , চিত্র সব কিছুরই এক মেল বন্ধন রয়েছে একে অপরের পরিপূরক । এবং এই শিল্পের মাধ্যমেই একজন সাধারণ মানুষ গড়ে তুলতে পারেন এক সুস্থ সমাজ যা একজনের গড়ে তোলার পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।