ছোট বেলায় বিভিন্ন বন্ধুদের মুখে বছরের বিভিন্ন সময়ে যখন তাদের দেশের বাড়িতে আয়োজিত কালীপুজোর কথা শুনতাম,সত্যি খুব অবাক হতাম। তখন মনে একটাই প্রশ্ন ঘোড়া ফেরা করত- ‘এত বার কালীপুজো হওয়া কিভাবে সম্ভব?’। পরবর্তীতে কালীপুজো ও কালী ঠাকুরের সম্পর্কিত বিষয় জ্ঞান অর্জন করায় ছোটবেলার বিস্মিত বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। কালীপুজো সারা ভারতে খুব জনপ্রিয়। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কালীর বিভিন্ন রূপকে বিভিন্ন মাসে পূজা করা হয়। কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা হল দেবীর বিভিন্ন রূপ যা আমাদের কাছে দশ মহাবিদ্যা নামে পরিচিত।
দেবীর কোনো রূপই একমাত্র ও নির্দিষ্ট নয়। তিনি লক্ষ্মী পুজোর পর আসেন দীপান্বিতা কালীপুজোর মাধ্যমে, ঠিক তার পর মাঘ মাসে আসেন রটন্তী কালীপুজোয় এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে তার আবির্ভাব হয় ফলহারিণী কালীপুজোয়। দেবীর নানারূপে বারংবার আবির্ভাব তার সকল ভক্তের আপ্লুত করে। প্রাচীন স্কন্দপুরাণে কালী ঠাকুরের আবির্ভাব নিয়ে বেশ আকৃতির বিস্মিত গল্পের উল্লেখ রয়েছে। বলা হয় পার্বতীর গায়ের রং কালো হওয়ায় একদিন সেটা নিয়ে ঠাট্টা করেন। তার পর পার্বতী অপমানিত বোধ করায় ব্রহ্মার তপস্যায় বসেন। এবং তিনি বর লাভ করায় তার কালো চর্মটি জলে পড়ে যায়। এরপর সেখান থেকে আবির্ভাব হয় ভয়ংকর অপরূপ দেবীর। তিরধনুক, খড়্গ, ভল্ল নিয়ে আট হাতওয়ালা দেবীকে আমরা কৌশিকী নামে চিনি, যিনি কালো, রুধিরাক্ত ও মাংসাশী।
বহু মানুষ আমাদের সমাজে নিজেদের দেবীর পরম ভক্ত হিসাবে দাবি করেন আবার অন্য দিকে তারাই গঞ্জিকাসেবন করে নেশায় জর্জরিত হয়ে থাকেন। তাদের কথা হল আমরা দেবীর ভক্ত তাই নেশা করব। তাই তাদের মত ভণ্ডদের উদ্দেশ্য কালীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত শ্রীরামকৃষ্ণ নিচু থাকের সিদ্ধির ও উঁচু থাকের সিদ্ধির তফাত করে দিয়েছিলেন। তিনি বারংবার সকলর চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সাধনায় সিদ্ধিলাভই সাধকের পরম লক্ষ্য, সিদ্ধাই নয়। তন্ত্র মানে শুধু কালীসাধনা নয়। শাস্ত্রেরই অন্য নাম সেটি। রামকৃষ্ণ ভৈরবী মায়ের কাছে দীক্ষিত ছিলেন। ফলে তন্ত্রভিত্তিক এই চর্চার সবচেয়ে বড় গুণ হলো এর কোনো বর্ন বৈষম্য নেই, জাত পাত বিভাজন নেই এবং নারী-পুরুষ বিভাজনও নেই। তবে সমস্ত বাঙালি মানুষ দীপাবলিতে চারিদিকে আলোকসজ্জা ও বাজির খেলাতে মগ্ন থাকেন। তবে বিস্তারিত জানার পর আমার মনে হয় আনন্দ, উযাপন তো থাকবেই তবে আগে আমাদের উচিত তন্ত্রের প্রাচীন পাঠগুলি খুঁটিয়ে দেখা এবং নিজেদের প্রাচীন অলংকার সম্পর্কিত বিষয় জ্ঞান অর্জন করা।